হাওর ও জলাভূমির পটভূমি
আমাদের দেশ একটা ব্যতিক্রম ধর্মী হেটোরেজেনাস কাঠামো। এতে আছে সমতল, আছে উচুনিচু পাহাড়, আছে সমুদ্র। সমুদ্রের সাথে আছে ১২১ কিলোমিটার সৈকত। আছে মিঠা পানির জলাভূমি। বনভূমি- সবুজ শ্যামল এই আমাদের বাংলাদেশ। গাছ গাছালী, পাখ পাখালী আর মাছ নিয়ে সম্পদের খনি এই দেশ। বন, পাহাড় আর লেক নিয়ে অপরুপ সৌন্দর্যের আধার নিয়ে তিন পার্বত্য জেলা। এশিয়ার বৃহৎ কৃত্রিম কাপ্তাই লেক বাংলাদেশকে করেছে অনিন্দ সুন্দর। পূর্বাঞ্চলের হা্ওরের গঠন শৈলী আর এর হিংশ্রতা মানুষকে সংগ্রামী আর কর্ম মূখর করেছে। জলাভূমি এলাকার মানুষের জীবনমান এবং পরিবেশ আর ইকো সিস্টেমকে আরো উন্নত করার প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ হা্ওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর।
১৯৪৭ সালের রেফারেন্ডামে সিলেট পাকিস্থানে থাকবে নাকি ভারতের অংশ হবে তার ক্যাম্পেইনের জন্য ৫০০ ছাত্র সিলেট সফর করেন। হাওর অঞ্চলে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কারনে তারা পৃথক একটা দপ্তরের কথা চিন্তা করেন। তারই ফলশ্রতিতে ১৯৭৪ সালে ”হাওর উন্নয়ন বোর্ড” গঠনের ঘোষনা দেয়া হয়। অত:পর ৭৭ সালে স্বপ্নের হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। কিন্তু নানা কারনে এই দপ্তরটি ঢিমে তালে চলতে থাকে। এরপর নানা চরাই উতরাই পার হয়ে ২০১৬ সালে জলাভূমিকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর গঠন করা হয়। উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৭ টি জেলা সহ সারা দেশের জলাভূমি- নদ নদী খাল বিল নিয়ে এই অধিদপ্তরের পথচলা। সমুদ্র ভাগের যে এলাকা ৬ মিটার গভীর সেটাও এর আওতাভূক্ত। আছে কাজ করার অপার সম্ভাবনা।
মোটা দাগে মরুকরন প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে জলাভূমির নাব্যতা বৃদ্ধি, প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মাছের উৎপাদন বাড়ানো, কার্বন এমিশন কমাতে আর সবুজায়ন করতে বৃক্ষ রোপন, স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহনে কমুনিটি বেজড পর্যটনের বিকাশ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ভাগীদার হতে চায় আমাদের হাওর অঞ্চলের অবহেলিত মানুষ।
১। হাওরের তলদেশ রক্ষনাবেক্ষণ (Sediment Management):
বাংলাদেশের জলাভূমির মারাত্বক সমস্যা এখন দাড়িয়েছে সেডিমেন্ট। এটা প্রতিহত করার সক্ষমতা আমাদের নাই তবে ম্যানেজ করার সুযোগ আছে। উজান থেকে ১৩ দেশের সম আয়তনের পাহাড় থেকে পানি নেমে আসে, সাথে নিয়ে আসে সেডিমেন্ট। বছরে এক বিলিয়ন টন সেডিমেন্ট আসায় হাওর, জলাভূমি ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এই জলাধারগুলির প্রধান কাজ হলো এলাকার মুরুকরণ প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা। একটা নির্দিষ্ট পরিমান মাটি কেটে হাওরের নাব্যতা সারা বছরের জন্য বাড়ানো যায়। মাটি উত্তোলন করে উন্নয়ন মূলক কাজে ব্যবহার করা যায় আবার বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। জলাভূমির নাব্যতা বাড়াতে পারলে সারা বছর মাছ চাষ করে ৬ গুন সাত গুন বেশী আয় করা সম্ভব হবে ফলে জিডিপির আকার বড় হবে, একইসাথে সমাজে মানি ফ্লো তৈরী হবে।
২। মাছের যোগান বাড়ানো :
আমাদের দেশে ৩৭৩টি হাওর, ১০০০ নদী, লক্ষাধিক খালবিলে ১০০ কোটি মাছ ছাড়া যায় আবার প্রাকৃতিক মাছগুলোকে বাইক্কা বিলের মতো সংরক্ষণ করা যায়। বাইক্কা বিলে ৩০ কেজি ৪০ কেজি সাইজের মাছ এখন সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এতে যে পরিমান মাছ চাষ করা সম্ভব তাতে আমাদের মাছের উৎপাদন অনেকগুন বেশী হবে। পুষ্টি চাহিদা মিটবে এবং মিঠা পানির মাছ রপ্তানীও করা যাবে।
৩। বৃক্ষ রোপন : রাতার গুল মডেল :
হাওর ও জলাশয়ে ১০০ কোটি করচ গাছ লাগনো যেতে পারে। প্রাকৃতিক ভাবে রাতার গুল পর্যটন এলাকার ন্যায় সকল হাওর রাতারগুল হতে পারে। গাছের গোড়ায় মাছ আশ্রয় নিবে এবং গাছের উপরে পাখী আশ্রয় নিতে পারবে। গাছগুলোর শিকড় বাধ কিংবা মাটি ক্ষয় হতে রক্ষা করে। কার্বন এমিশন ড্রামেটিক্যালী কমে আসবে। দেশীয় প্রজাতি হিজল তমাল গাছও লাগনো যেতে পারে।
৪। পর্যটন সম্ভাবনা তৈরী :
আমাদের ১৭ কোটি মানুষ- সবাই কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতে চায়। এটা এখন আর সৌখিনতা নয়। সবাই তো কক্সবাজারে যেতে পারে না। হাওর ও জলাভূমিতে বেড়ানোর ব্যব্স্থা করা যায়। মানুষ যেখানে দুই ঘন্টার বেশী থাকে সেখানে বাথরুম থাকতে হবে। যেখানে তিনঘন্টার বেশী থাকার প্রয়োজন হবে সেখানে খাবার হোটেল রেস্তোরা থাকতে হবে। কমিউনিটি বেজড পর্যটন পরিচালনা করা যেতে পারে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ অথবা উপজেলা পরিষদ দেখভাল করতে পারে এবং তাদের আয়ও হতে পারে। রেমাক্রি বা সাজেক মডেলে বাড়ীতে ভাড়া সিস্টেমে পর্যটক রাখা যেতে পারে একই সাথে পর্যটকদের খাবার সরবরাহও করা যায়। ফলে স্থানীয় লোকজন অর্থ উপার্যন করতে পারে আবার পর্যটনে তাদের আগ্রহ ও অংশগ্রহন দুটোই বাড়বে।
৫। আমার গ্রাম হবে আমার শহর :
জন্ম থেকে হাওরের মানুষ হাওরের পানি খায়, হাওরে গোসল করে আবার হাওরের পানিতে পায়খানা করে। হাওরের মানুষের জীবন মান বাড়ানোর জন্য হাওরের গ্রামগুলিকে প্রটেকশন ওয়াল দিতে হবে সুইডেন মডেলে। গাছ লাগনো থাকবে বাগানের মতো, সোলার সিস্টেম থাকবে পুরো এলাকায়- লোকজন যেন আইটি সাপোর্ট পায়, ওয়াই ফাই ব্যবহার করতে পারে। সেনিটেশন থাকবে পুরো পরিবারের মতো। খাবার পানি সবার জন্য সহজ লভ্য করতে হবে। বর্যার দিনে চলাচলে ওয়াক ওয়ে তৈরী করা প্রয়োজন। সাইলো গোডাউন তৈরী করা অতিব জরুরী। মাছ রিজার্ভ করার জন্য স্টোরেজ নির্মান করা যেতে পারে।
৬। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন :
হাওর অঞ্চলের ৩৭৩ হাওরের ৩৭টি উপজেলা প্রোপারকে কানেকটেড করে ১০০ কিলোমিটার ফ্লাই ওভার নির্মান করলে মানুষজনের মবিলিটি বাড়বে অপরদিকে পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যবে। অল ওয়েদার রোড যেটা বানানো হয়েছে তাতে করে পানি প্রবাহ কিংবা সেডিমেন্ট ও জলজ প্রাণীর চলাচলে মারাত্বক বিঘ্ন ঘটছে। ধরে নেয়া যায় আগামীতে এখানকার চরিত্র বদলে যাবে- যেমনটা ঘটেছে চলন বিল এলাকায় বৃটিশ আমলে যে রেল লাইন তৈরী করা হযেছে তাতে চলন বিল এর গতি প্রকৃতি বদলে গেছে। ছোট আকারের হলেও সাব মার্জিবল রোড একই সমস্যা তৈরী করছে- এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
৭। পরিবেশ উন্নয়ন:
বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিবেশ বিরাজ করছে তা মোটেই গ্রহনযোগ্য নহে। বাতাসে কার্বনের মাত্রা বেশী, ধুলাবালি বেশী, শব্দদুষন বেশী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মারাত্বক দুর্বল। এর চেয়ে বেশী খারাপ মানুষের জীবন যাত্রার মান। ভারত, চায়না, নেপাল থেকে সেডিমেন্ট গড়িয়ে এসে আমাদের হাওর ও নদনদী ভরাট করে চলেছে। এজন্য নিয়মিত মাটি ড্রেজিং করে হাওর ও নদনদী সারাবছর নাব্য রাখা প্রয়োজন। মাটিগুলি দেশের উন্নয়ন মূলক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং বিদেশে রপ্তানী করা যেতে পারে। জলাভূমি এলাকায় কয়েক কোটি গাছ লাগালে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে। প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে সমাজের গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বসবাসের উপযোগী হলে সেখানকার বাজেট এবং উন্নয়ন উভয়েরই উন্নয়ন ঘটবে। পর্যটনকে সহনশীল করতে পারলে মানুষের মনোজাগতিক উন্নয়ন ও অর্থ আয় বাড়বে। মাছ ও পাখীর অভয়ারন্য তৈরী করলে পরিবেশকে আরও উন্নত করা সম্ভব।
৮। নৌ চ্যানেল অগ্রাধিকার :
হাওর এলাকায় প্রতি জেলা উপজেলার সাথে গ্রাম বন্দরের সাথে নৌ চ্যানেল বানানো যেতে পারে। সাবমার্জিবল রোড বানানো ক্ষতিকর বিধায় মালদ্বীপ বা ইউরোপের মতো নৌ চ্যানেল কম খরচে ব্যবহার উপযোগী হতে পারে। স্পীড বোট বা নৌকার রুট হাওর ছাড়াও কাপ্তাই লেকে রাংগামাটি থেকে ১০ উপজেলায় করা যেতে পারে।
৯। আবাসন সুবিধা :
বৃটিসদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং আমাদের সম্পত্তি বিভাজনের প্রক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশের ফসলী জমি এবং জলাভূমি বিলীন হতে চলেছে। জনসংখ্যা বাড়ার কারনে আবাসন সুবিধা তৈরীর লক্ষ্যে প্রতি ইউনিয়নে একটি আবাসিক এলাকা তৈরী করা যায়। উন্নত দেশসমূহের মতো যেখানে থাকবে ৫০টি ২০ তলা বিল্ডিং। ইউনিয়নের সকল নাগরিক একসাথে বসবাস করবে, বিদ্যুৎ গ্যাস পানি ওয়াইফাই সহ সকল ইউটিলিটি সার্ভিস (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কমুনিটি সেন্টার, বাজার সপিং মল,বাস টার্মিনাল) একসাথে থাকবে। সরকারের খরচ কম হবে। শুধু তাই না ফসলী জমি, জলাভূমি উদ্ধার ও রক্ষা করা সম্ভব হবে। পরিবেশ আরো উন্নত করা সম্ভব হবে।
১০। কর্মসংস্থান :
মহিলাদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, হাস পালন প্রশিক্ষণ, সুটকী মাছ প্রস্তুতকরন, পুরুষদের জন্য ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভিং, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। নার্সিং, ডে কেয়ার সেন্টার পরিচালনা সহ নানাবিধ প্রশিক্ষণ প্রদান করে বিদেশের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। এছাড়া এলাকা ভিত্তিক অন্যান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে যুবকদেরকে বিদেশে প্রেরন করা যেতে পারে।
শেষ কথা :
দিনাজপুরের আশুরার বিল, নাটোরের চলন বিল, যশোরের ভবদহ বিল, টুংগীপাড়ার বর্ণি বাওড়, মুন্সিগঞ্জের আরিয়াল বিল, পার্বত্য এলাকার কাপ্তাই লেক, বগা লেক চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে সীতাকুন্ড ও মিরেরশরাই এলাকায় একই ধরনের প্রকল্প নেয়া যায়। একই ভাবে কুয়াকাটা বিচ, কক্সবাজার বিচ ইত্যাদিতে পর্যটন সহায়ক প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। সুন্দরবন এলাকা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর মন কেড়েছে। এখানে পরিদর্শন সহায়ক ও ইকো সিস্টেম উন্নত করার জন্য বিশেষ প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। টাংগুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওর প্রকৃতিকে করেছে অপরুপ। জলাভূমিগুলো কোনটা কোনটার চেয়ে সুন্দর আর সম্পদশালী তা বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে থাকতে হয়।
৯ মার্চ ২০২৫।
মোঃ আখতারুজ্জামান
মহাপরিচালক
হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তর।